একজন জীবনমুখী ও গরিবমুখী যোদ্ধা

 ড. মাহবুব উল্লাহ

আমাদের প্রিয় ডা. জাফরুল্লাহ ভাই মঙ্গলবার ১১ এপ্রিল রাত ১১টার দিকে রাজধানীর গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালে ইন্তেকাল করেন।

তিনি বেশ কিছুদিন ধরেই অসুস্থ ছিলেন। তার কিডনি পুরোপুরি বিকল হয়ে গিয়েছিল। তাকে নিয়মিত ডায়ালাইসিস করতে হতো।

তিনি ডায়ালাইসিস করতেন তারই প্রতিষ্ঠিত গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালে। ইচ্ছা করলে তিনি আরও ব্যয়বহুল হাসপাতালে এ চিকিৎসা করাতে পারতেন।

কিন্তু তিনি তা করেননি। তার নৈতিক অবস্থান ছিল খুবই দৃঢ়। গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালের চিকিৎসা ব্যয় তুলনামূলক অনেক কম। তিনি এ হাসপাতালে অপেক্ষাকৃত দরিদ্র রোগীদের চিকিৎসা নিতে বলতেন। কারণ, এ হাসপাতালের চিকিৎসা ব্যয় অন্য যে কোনো বেসরকারি হাসপাতালের তুলনায় অনেক কম। তিনি তার নৈতিক অবস্থান থেকেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তার চিকিৎসা গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালেই করাবেন। সেখানেই তিনি চিকিৎসা নিয়েছেন এবং সেখানেই জীবনের শেষ প্রহরগুলো কাটিয়েছেন।

ডা. জাফরুল্লাহ চোধুরীর উন্নততর চিকিৎসার জন্য জার্মানি ও কানাডা সরকারের কাছ থেকে আমন্ত্রণ এসেছিল। তিনি বিনয়ের সঙ্গে এ আমন্ত্রণ গ্রহণ করতে অপারগতা প্রদর্শন করেন। এরকম নীতিনিষ্ঠ মানুষ পাওয়া খুবই কঠিন। তিনি বলতেন, যে দেশের গরিব মানুষ ন্যূনতম চিকিৎসাসেবা পায় না, সেদেশের একজন নাগরিক হয়ে আমি কী করে জার্মানি ও কানাডার মতো ধনী দেশে চিকিৎসাসেবা নিই? তাকে পাকিস্তান থেকেও চিকিৎসাসেবার জন্য আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। তিনি সেই আমন্ত্রণও গ্রহণ করেননি। তার কথা ছিল, যাদের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধ করেছি, তাদের কাছ থেকে এখন কী করে চিকিৎসাসেবা নিই? তার জীবনের এ কথাগুলো অনেকেই জানেন না।

মানুষ হিসাবে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী ছিলেন অকুতভয়। তিনি যা বিশ্বাস করতেন, তা-ই করতেন। কারও মনমেজাজ বা চোখের রং দেখে কথা বলতেন না। তিনি ছিলেন একজন নিরাপস মানুষ। জীবনের শেষমুহূর্ত পর্যন্ত তিনি দেশ ও দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তাগ্রস্ত ছিলেন। তার স্ত্রীর কাছ থেকে শুনেছি, শেষবারের মতো হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার আগে তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করেছিলেন হুইলচেয়ারে বসে। তার আবেদন ছিল, দেশটাকে বাঁচান, আপনারা সংলাপে বসুন। এর জবাবে প্রধানমন্ত্রী কী বলেছিলেন, তা জানা যায়নি। বাসায় ফিরে তিনি বারবার বলছিলেন, দেশটাকে বাঁচানো গেল না। এরপর থেকে তিনি বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন। কোনো কথা বলছিলেন না। বিস্ফারিত চোখে শুধু তাকিয়ে থাকতেন। এ অবস্থায় তাকে হাসপাতালে নেওয়া হয়। তিনি আর ফিরে এলেন না। যে দেশের মানুষের জন্য তিনি তার জীবন উৎসর্গ করেছিলেন, সেই মানুষ ও সেই দেশের মায়া কাটিয়ে তিনি পরপারে চলে গেছেন। আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দিন এবং জান্নাতুল ফেরদৌস নসিব করুন।

ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় ১৯৭৭ সালে। মুক্তিযুদ্ধের সময় এবং এর আগে এক বছর মোট ২২ মাস আমি কারারুদ্ধ ছিলাম। স্বাধীন জনগণতান্ত্রিক পূর্ববাংলার দাবি উত্থাপনের পর সামরিক আদালতে আমার বিচার ও কারাদণ্ড হয়। এ কারণে আমি মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি যোগ দিতে পারিনি। আর এজন্যই ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হতে কিছু বিলম্ব হয়ে যায়। ডা. জাফরুল্লাহ ১৯৭৭ সালে গণস্বাস্থ্যের সাভার কেন্দ্রে একটি আন্তর্জাতিক সেমিনারের আয়োজন করেছিলেন। দেশ-বিদেশের নামকরা চিকিৎসকরা ওই সেমিনারে যোগ দিয়েছিলেন। সেমিনারে বক্তারা যে বিষয়টির ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন তা হলো, সমাজের কথা না ভেবে রোগীকে ভালো চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হয় না। ডা. জাফরুল্লাহ আমাকে আমন্ত্রিত অতিথিদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন, ও হলো বাংলাদেশের রুডি ডাস্কি। আমি উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলাম। সেসময় আমি খুব আগুনঝরা বক্তৃতা করতাম। রুডি ডাস্কি ফ্রান্সে ১৯৬৮ সালে ছাত্র-শ্রমিক অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। এ কারণেই ডা. জাফরুল্লাহ ভাই আমাকে রুডি ডাস্কির সঙ্গে তুলনা করে দেখিয়েছিলেন। এরপর থেকে বরাবরই ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী আমার ও আমার পরিবারের প্রতি অত্যন্ত বন্ধুবৎসল এবং বিপদের আশ্রয়রূপে দায়িত্ব পালন করেছেন। তার মতো বন্ধুবৎসল মানুষ এ সময়ে খুঁজে পাওয়া কঠিন।

ছাত্রজীবন থেকে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বাম ধারার রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তিনি যেসব প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিলেন, সেগুলোর লক্ষ্য কখনোই মুনাফা অর্জন ছিল না। লক্ষ্য ছিল জনকল্যাণ। স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে তিনি যে মডেলটি দাঁড় করিয়েছেন, সে পথেই জাতীয় স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়ন ঘটালে এদেশের সাধারণ মানুষ উপকৃত হতো। আশা করি, রাজনীতিবিদরা এবং রাষ্ট্রের কর্ণধাররা এ বিষয়টি ভেবে দেখবেন।

ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী ১৯৮২ সালে জাতীয় ঔষধনীতি প্রণয়নে খুবই সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। এ ঔষধনীতিতে অপ্রয়োজনীয় ওষুধ বেআইনি ঘোষণা করা হয়। প্রয়োজনীয় ওষুধ কীভাবে সুলভমূল্যে উৎপাদন করা যায়, তার পথদ্রষ্টাও ছিলেন তিনি। জাতীয় ঔষধনীতি ১৯৮২-এর ফলে দেশে ওষুধশিল্পের প্রসার ঘটেছে। আজ বাংলাদেশের ওষুধ বিশ্বের উন্নত দেশগুলোয়ও রপ্তানি হয়। ওষুধশিল্পকে কেন্দ্র করে দেশে এক নতুন ধরনের উদ্যোক্তা তৈরি হয়েছে। এসবকিছু ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীরই অবদান।

মুক্তিযুদ্ধের মৌলিক অঙ্গীকারের প্রতি তিনি ছিলেন দায়বদ্ধ। চিকিৎসাসেবাকে গরিববান্ধব করার জন্য গরিববান্ধব চিকিৎসক প্রয়োজন বলে তিনি মনে করতেন। এজন্য নিয়ম করেছিলেন গণস্বাস্থ্য মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীদের একটি সময় গ্রামে কাটাতে হবে। এর সুফলও পাওয়া গেছে।

সব মিলে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী ছিলেন একজন জীবনমুখী, মানবমুখী, দেশমুখী এবং সবার ওপরে গরিবমুখী সচেতন যোদ্ধা। আশা করব, ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর উত্তরসূরিরা তার এ আদর্শকে একটি অব্যাহত ধারায় পরিণত করবেন।

ড. মাহবুব উল্লাহ : শিক্ষাবিদ ও অর্থনীতিবিদ

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *