চিত্রনায়ক এখন গাউছিয়া মার্কেটের কাপড় ব্যবসায়ী

বিয়ানীবাজারের ডাক ডেস্ক:

মেয়ের বয়স তখন আঠারো। পড়ত কলেজে। পরীক্ষায় খারাপ ফল করল। আবেগে ফ্যানের সঙ্গে ঝুলে পড়ল। রাতে ব্যবসার কাজে বাইরে ছিলেন শাহিন আলম। মেয়ের সিলিংয়ে ঝোলার খবর শুনে ছুটে এলেন। দেখলেন মেয়ে তাঁর পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছে। একমাত্র মেয়ের মৃত্যুর পর ভেঙে পড়লেন মানসিকভাবে, বদলে গেল শাহিন আলমের জীবন। ছেড়ে দিলেন অভিনয়। আগেই অভিনয়ের সঙ্গে টুকটাক গার্মেন্টসের ব্যবসা করতেন। সেটাকেই জীবিকা হিসেবে নিলেন। এখন তিনি পুরোদস্তর ব্যবসায়ী।

হুট করে সিদ্ধান্ত নিলেও তখন যে ছবিগুলো হাতে ছিল, সেগুলোর কাজ শেষ করে দিলেন। নতুন করে আর কোনো ছবির কাজ হাতে নিলেন না। শেষ তিনি ক্যামেরার সামনে দাঁড়ান রকিবুল আলম পরিচালিত ‘দারোয়ানের ছেলে’ ছবির জন্য। শেষের দিকে কাজী হায়াতের অনুরোধে দু-একটি ছবিতে কাজ করেছেন। তাঁরও আগেই থেকেই তিনি অভিনয় থেকে পালিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছিলেন।

‘সিনেমা যখন পরিচালকদের হাত থেকে প্রযোজকদের হাতে চলে গেল, তখন থেকেই সিনেমার অবস্থা খারাপ হতে শুরু করল। প্রযোজকেরা আমার কাছে ভালগার শট দেওয়ার অনেক অনুরোধ করেছে। আমি করিনি। পরে তারা কাটপিস শুট করেছে। পর্দায় আমার ক্লোজআপ ব্যবহার করেছে। আমি ধরলে বলেছে, না করে উপায় নেই, ভাই। এসব দেখেশুনে অভিনয়ের নেশাটা কেটে গেল। আর নেশা না থাকলে পেশায় কতক্ষণ থাকা যায়?’ বললেন শাহিন আলম।

প্রায় দেড় শ ছবিতে অভিনয়ের পর শাহিন আলম ব্যবসায় মনোযোগ দেন। অভিনয়ের পাশাপাশি গার্মেন্টসের ব্যবসা করতেন। অভিনয় ছাড়ার পর পুরোপুরি সেখানেই মন দেন। কিন্তু গার্মেন্টসের ব্যবসায় সুবিধা করে উঠতে পারেননি। রাজধানীর গাউছিয়ায় তাঁদের পৈতৃক দুটো শোরুম ছিল। অভিনয় ছাড়ার পর এই শোরুমগুলোতে ব্যবসা শুরু করেন শাহিন আলম। একটি শোরুম ভাড়ায় চলে। আরেকটি শোরুমে নিজে ব্যবসা করেন।

আগে নিজেই শোরুমে বসতেন। এখন তাঁর ভাতিজা বসেন। কারণ, চার বছর ধরে গুরুতর অসুস্থ শাহিন আলম। জটিল কিডনি রোগে ভুগছেন। সাড়ে তিন বছর ধরে ডায়ালাইসিস চলছে। প্রতি সপ্তাহে তিন দিন সাভারের গণস্বাস্থ্যকেন্দ্রে ডায়ালাইসিসের জন্য যেতে হয় তাকে। তাঁর অসুস্থতার খবর খুব বেশি লোকের জানা নেই। শাহিন আলম বললেন, ‘অভিনয় ছাড়ার পর প্রথম দুই বছর অনেকে যোগাযোগ করত। যখন সবাই জেনে গেল, অভিনয় ছেড়ে দিয়েছি, তখন আর তেমন কেউ যোগাযোগ করে না।’

শাহিন আলম জানালেন, সিনেমার লোকদের মধ্যে অমিত হাসান ও মিশা সওদাগর নিয়মিত তাঁর খোঁজখবর নেন। অনেক দিন আগে শিল্পী সমিতির কয়েকজন তাঁকে দেখতে এসেছিলেন। কেউ কেউ তাঁকে বলেছেন, চিকিৎসার সহযোগিতার জন্য শিল্পী সমিতির সঙ্গে যোগাযোগ করতে। কিন্তু শাহিন আলম তা করেননি। সরকারের কাছ থেকে চিকিৎসা সহায়তা নেওয়ার জন্যও তদবির করেননি। অথচ তিনি গুরুতর অসুস্থ।
শাহিন আলম বললেন, ‘আমার মনে হয়েছে, যারা দুস্থ, আমার চেয়েও যাদের বেশি প্রয়োজন, তারা যাক। এত দিন আল্লাহ একভাবে চালিয়ে নিয়েছেন। সহায়তার কথা ভাবিনি। কিন্তু করোনায় ব্যবসার অবস্থা খারাপ। এখন চাইছি সরকার আমাদের দিকে তাকাক।’ তিনি জানালেন, ছোট বোন তাঁকে যথেষ্ট সহযোগিতা করেছেন। করোনার সময়ও তাঁকে পাশে পেয়েছেন। গুলশানের নিকেতনে নিজের ফ্ল্যাটে থাকেন শাহিন আলম। স্ত্রী ও বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া একমাত্র ছেলেকে নিয়ে তাঁর সংসার।

শাহিন আলম জানালেন, দেড় শতাধিক ছবিতে অভিনয় করেছেন তিনি। অর্থনৈতিকভাবেও পায়ের নিচে শক্ত জমি তৈরি করেছেন। অসুস্থ হওয়ার আগে পর্যন্ত তাঁর কোনো অসুবিধা ছিল না। ১৯৯১ সালে তাঁর অভিনীত ‘মায়ের কান্না’ ছবিটি মুক্তি পাওয়ার পর একসঙ্গে ৭টি ছবিতে সাইন করেন। তখন থেকে পেছনে না তাকিয়ে একটানা কাজ করে গেছেন। এই কাজ তাঁর ভিত গড়ে দিয়েছে।

শাহিন আলম অভিনীত উল্লেখযোগ্য ছবি ‘ঘাটের মাঝি’, ‘এক পলকে’, ‘প্রেম দিওয়ানা’, ‘চাঁদাবাজ’, ‘প্রেম প্রতিশোধ’, ‘টাইগার’, ‘রাগ-অনুরাগ’, ‘দাগি সন্তান’, ‘বাঘা-বাঘিনী’, ‘স্বপ্নের নায়ক’, ‘আরিফ লায়লা’, ‘আঞ্জুমান’, ‘অজানা শত্রু’, ‘গরিবের সংসার’, ‘দেশদ্রোহী’, ‘আমার মা’, ‘পাগলা বাবুল’, ‘তেজী’, ‘শক্তির লড়াই’, ‘দলপতি’, ‘পাপী সন্তান’, ‘ঢাকাইয়া মাস্তান’, ‘বিগবস’, ‘বাবা’, ‘বাঘের বাচ্চা’, ‘বিদ্রোহী সালাউদ্দিন’, ‘তেজী পুরুষ’ ইত্যাদি।

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *