“গার্মেন্ট শ্রমিকদের কাছ থেকে কিছু শেখার আছে”

বিয়ানীবাজারের ডাক ডেস্কঃ

গোটা পৃথিবী আজ কোভিড মহামারীতে আক্রান্ত। করোনা একটা ভাইরাসজনিত অসুখ হলেও মহামারী কোনভাবেই নিছক রোগ এবং তার চিকিৎসা সংশ্লিষ্ট সংকট না। মহামারী যে খুবই রাজনৈতিক ব্যাপার সেটা প্রতিদিন আরো স্পস্ট হচ্ছে। আমরা দেখতে পাচ্ছি করোনা মহামারীতে পৃথিবীর দেশে দেশে মানুষের ক্ষয়ক্ষতি নির্ভর করছে যার যার শাসক ও সরকারের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক মতাদর্শের ওপরে।

ঠিক যেমন বাংলাদেশে হাসিনা সরকারের ‘উন্নয়নের জোয়ারে’ আক্ষরিক অর্থেই মানুষের লাশ ভেসে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। দেশে ভাইরাসের সংক্রমণ মানুষের এখতিয়ার বহির্ভূত ও অনিবার্য হতে পারে, কিন্তু দেশে এই মহামারী পরিস্থিতিতে যে ক্ষুধা-মৃত্যু-চিকিৎসাহীনতা এবং রাষ্ট্রীয় দমন চলছে সেটা সম্পূর্ণ মানবসৃষ্ট। সম্ভবত এই সময়টাতে ক্ষমতাসীনদের সাথে জনতার দ্বন্দের সবচেয়ে চরম পর্যায়টি আমরা অতিক্রম করছি। যারা পরিস্থিতিকে মানুষের এখতিয়ার বহির্ভূত একটি দুর্যোগ মোকাবেলা বা নিছক মেডিকেল ইমার্জেন্সি হিসেবে দেখছেন নির্মম সত্য হলো তারা ইতোমধ্যেই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পরেছেন। এই অবস্থায় দেশের গার্মেন্ট শ্রমিকদের অবস্থান ও ভূমিকা খুবই উজ্জ্বল। গার্মেন্ট শ্রমিকদের কাছ থেকে শেখার আছে।

এই পুরো সময়টাতে গার্মেন্ট শ্রমিকরা লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশে করোনা পরিস্থিতির একেবারে শুরুতেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে নিজেদের মুনাফার হার ঠিকঠাক রাখা ও সরকারের কাছ থেকে বড় অংকের সুবিধা আদায় করতে মালিকরা ব্যস্ত হয়েছে। এই সময়কালে মালিকরা আর্থিক সুবিধা আদায়ে সরকারের সাথে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় দরকষাকষি শুরু করে। একইসময়ে শ্রমিকদের ওপর বেতন না দেয়া, লে-অফ, ছাটাই, চাকুরিচ্যুতিসহ ইতিহাসের জঘন্যতম জুলুম নেমে আসে। এই সময়কালে যেভাবে শ্রমিকরা ধারাবাহিকভাবে আন্দোলন চালিয়েছে অতীতে কখনো এত লম্বা সময় ধরে গার্মেন্ট শ্রমিকের আন্দোলন করতে দেখি নাই।

সরকার দেশে করোনা সংক্রমণ সনাক্ত হওয়ার কথা ৮ মার্চ প্রথম ঘোষণা করে। গার্মেন্ট টিইউসি মার্চের ১৮ তারিখ বলেছিলো কারখানায় কর্মরত শ্রমিকরা সবচেয়ে অনিরাপদ ও ঝুকিপূর্ণ অবস্থায় আছে এবং অবিলম্বে শ্রমিকদের সবেতন ছুটি দিতে হবে। একই সময়ে মালিকরা তাদের ‘সব অর্ডার বাতিল’ হওয়ার প্রচার এবং আর্থিক সুবিধা আদায়ের দেনদরবার শুরু করে। পাশাপাশি মালিকরা সবেতন ছুটির পরিবর্তে কারখানা লে-অফের করার পায়তারা শুরু করলে ২১ মার্চ গার্মেন্ট টিইউসি মহামারী পরিস্থিতিতে লে-অফ ও ছাটাই নিষিদ্ধের দাবি জানায়।

এই সংক্রমণের ঝুঁকির মধ্যেই ২৪ মার্চ গার্মেন্ট টিইউসি গাজীপুরের ঝর্ণা নীটওয়ার কারখানার শ্রমিকদের বকেয়া পাওনা পরিশোধের দাবিতে সকাল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত মালিকের বাড়ি অবরোধ করে রাখে। ২৫ মার্চ শ্রমিকদের আংশিক পাওনা পরিশোধ করা হয়। সরকার ২৬ মার্চ থেকে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে। এসময় সরকার শ্রমিকদের তিন মাসের বেতন বাবদ পাঁচ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা ঘোষণা করে। যে মালিকরা এত দিন কাজ নাই কাজ নাই বলে মাথা ঠুকলেন তারাই এবার সাধারণ ছুটির মধ্যে কারখানা খুলে দেয়ার জন্য উঠে পরে লাগলেন। সংক্রমণ প্রতিরোধে সরকার ঘোষিত দেশব্যাপী সাধারণ ছুটির সময় মালিকরা অনেক কারখানা খোলা রেখেছে। অনেক বন্ধ কারখানা এপ্রিলের শুরুতেই সরকারের সম্মতিতে হঠাৎ খুলে দেয়ার ঘোষণা দেয়া হয়। কাজে যোগ না দিলে শ্রমিকদের চাকুরিচ্যুতির হুমকি দেয়া হয়। ফলে গণপরিবহন বন্ধ থাকায় হাজার হাজার শ্রমিক কয়েকশত কিলোমিটার পায়ে হেটে, অযান্ত্রিক যানবাহনে চেপে কর্মস্থলে ফেরে। যা শ্রমিকদের ব্যপক সংক্রমণের ঝুঁকির মুখে ফেলে। তখন সাধারণ মানুষের তীব্র প্রতিবাদের মুখে আবার কারখানা বন্ধ ঘোষণা করা হয়। এর পরেই নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুরে আমরা অধিক সংক্রমণ দেখতে পাই।

কারখানাগুলো এসময় পুরোদমে খুলে দিতে না পেরে মালিকরা লে-অফ নোটিশ দিতে শুরু করে। এমনকি বিজিএমইএ সভাপতি সাধারণভাবে সকল কারখানা লে-অফ ঘোষণা করে সরকারকে চিঠি দেন। লে-অফ মানে শ্রমিকরা এই সময়ে তাদের মূল মজুরির অর্ধেক পাবে। মালিকরা ঠিকই সাধারণ ছুটির মধ্যেই কারখানা খোলার জন্য সরকারকে রাজি করান এবং এপ্রিলের শেষে কারখানা সম্পুর্ণভাবে খুলে দেয়া হয়। শুধু তাই না মালিক সমিতির নেতারা এসময় প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিবের সাথে সভা করে শ্রমিকদের এপ্রিল মাসের বেতন চল্লিশভাগ কেটে রাখার সিদ্ধান্ত জারি করান। পরে একই পদ্ধতিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীকে ব্যবহার করে ঈদ বোনাসও কর্তনের সিদ্ধান্ত হয়।

করোনা সংক্রমণের ঝুকি নিয়েই শ্রমিকরা কাজ করছে। কাজ করতে গিয়ে আক্রান্ত হলে অন্যরা ক্ষতিপূরণ পেলেও শ্রমিকরা উল্টো চাকরি হারাচ্ছে। আমাদের কাছে এমন প্রচুর অভিযোগ আছে, জ্বর-সর্দির জন্য শ্রমিককে ছুটিতে পাঠিয়ে আর কাজে নেয়া হয়নি। অন্যদিকে আক্রান্তরা চিকিৎসাও পাচ্ছেনা। সবচেয়ে বড় কথা বাধ্য হয়ে শ্রমিকদের উপসর্গ লুকাতে হচ্ছে, যা আরো বড় ঝুকি সৃষ্টি করছে।

শ্রমিক ছাটাই ও চাকুরিচ্যুতি চলছেই। মহামারী পরিস্থিতির শুরু থেকে ছাটাই হয়েছে। সে সময়ে শুধুমাত্র গার্মেন্ট টিইউসির দপ্তরে রেজিস্টার্ড অভিযোগের ভিত্তিতেই বলা যায় কমপক্ষে ৭০ হাজার ছাটাই এর ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু ঈদের পরেই চাকুরিচ্যুতি ও মিথ্যা মামলায় শ্রমিকদের ব্যপক হয়রানি শুরু হয়েছে। মোদ্দকথা চুপেচাপে ব্যপক হারে চাকুরিচ্যুতি চলছেই। এর মধ্যেই বিজিএমইএ সভাপতি আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করেছেন তারা আরো শ্রমিক ছাটাই করবেন। যদিও দেশের বিদ্যমান শ্রম আইন শ্রমিক স্বার্থ বিরোধী তার পরেও শ্রমিকরা কিছু আইনগত নিরাপত্তা পেয়ে থাকে। চাইলেই একজন শ্রমিককে চাকুরিচ্যুত করা যায় না। শ্রমিককে তার চাকুরির বয়স অনুযায়ী কিছু ক্ষতিপূরন ও সুবিধা দিতে হয়। মালিকরা কোভিড মহামারীকে ছুতো হিসেবে ব্যবহার করে শ্রমিকের সেই সকল পাওনা পরিশোধ করা থেকে রেহাই চাচ্ছে। এই বিষয়ে তারা সরকারের সাথে দেনদরবার চালাচ্ছে। এটা দিনের আলোর মতো স্পষ্ট যে, সরকার মালিকদের কথায় উঠবস করে, মালিকরা আবদার করলেই শ্রমিকের বেতন ও বোনাস কমিয়ে দেয়। তাই সামনের দিনে শ্রমিকের জন্য ঘোর অন্ধকার আর মরণ ছাড়া আর কিছু দেখা যাচ্ছে না।

সংবাদপত্রে এসেছে, মালিক সমিতির সভাপতি বলেছেন ৫৫ শতাংশ কাজ নেই। এই ৫৫ শতাংশ অর্ডার বাতিল হয়ে যাওয়ার তথ্যটা একটা ডাহা মিথ্যা কথা। গার্মেন্ট শিল্প একটা গ্লোবাল ইন্ডাস্ট্রি, এখানে তথ্য কিছুটা হলেও সহজ প্রাপ্য। আমরা দেখেছি, মালিকরা কোভিড পরিস্থিতির শুরুতেই প্রণোদনার জন্য সরকারের সাথে এযাবৎকালের সবচেয়ে বড় অংকের দরকষাকষি শুরু করে। সেই দরকষাকষি এখনো চলছে, আর এই দরকষাকষিতে মালিকদের সবচেয়ে বড় অস্ত্র হচ্ছে শ্রমিক ছাটাই এর হুমকি। তারা প্রথমে অর্ডার বাতিল ও কাজ নাই এই কথা বলে সরকারের কাছ থেকে শ্রমিকের তিন মাসের বেতন আদায় করেছে। পরে আবার লকডাউন পরিস্থিতির মধ্যে কারখানা না খুলে দিলে আমরা পিছিয়ে পরবো অযুহাতে শ্রমিকদের ঝুঁকিতে ফেলে কারখানা খোলা হয়েছে। এর পরে ছাটাই করা হবে না এই অঙ্গীকার করে এপ্রিলের বেতন ৩৫ শতাংশ এবং ঈদ বোনাস অর্ধেক কেটে নিয়েছে। এখন শ্রমিককে চাকুরিচ্যুত করার জন্যও তারা সরকারের সাহায্য চায়।

সমগ্র চাকুরি জীবনের সঞ্চয় তার আইনানুগ পাওনা থেকে পুরাতন শ্রমিককে নানান কৌশলে বঞ্চিত করে চাকুরিচ্যুতি এবং নতুন শ্রমিক নেয়ার কাজটা গার্মেন্ট শিল্পে মালিকরা নিয়মিত করে থাকে। কোথাও কোথাও এত ঝামেলা না করে কাগজপত্রে শুধু কাজে যোগদানের তারিখ বদলে দেয়া হয়। গোটা পৃথিবীর মানুষের এতবড় বিপদের সময়ে তারা সুযোগ বুঝে এই কুকাজ আরো বেশি করে চালিয়ে যাচ্ছে। এই অবস্থায় শ্রমিকদের মধ্যে সীমাহীন আতঙ্ক বিরাজ করছে। শ্রম আইনে শ্রমিকের জন্য যতটুকু নিরাপত্তা বলয় আছে এই মহা দুর্যোগকালে সেটাও যদি আমরা রক্ষা করতে না পারি তাহলে আমাদের চরম বর্বরতার শিকার হতে হবে।

সরকারের ওপর কোন ভাবেই আস্থা রাখার সুযোগ নেই। এমন মহামারীতে একদিকে মানুষ বিনা চিকিৎসায় মারা যাচ্ছে অন্যদিকে বেসরকারি হাসপাতাল গুলোকে ব্যবসার জন্য ছেড়ে দেয়া হয়েছে। প্রতিটা ক্ষেত্রেই চলছে মহামারীর সুযোগ কাজে লাগিয়ে গুটিকয়েক গোষ্ঠীর আখের গোছানো। এ পরিস্থিতি যে ভয়ংকর পরিণতি ডেকে আনছে সেটা কিন্তু শুধু গার্মেন্ট শ্রমিকদের মাঝে সীমাবদ্ধ থাকবে না।

কিন্তু এত সব জুলুম অনাচারের মধ্যেই আপনি আশার আলো দেখতে পাবেন। শ্রমিকরা এমন মহামারী পরিস্থিতি, মালিকশ্রেণীর প্রবল চাপ এবং রাষ্ট্র কিংবা সংক্রমণের চোখ রাঙ্গানো কোন কিছুতেই কুপোকাত হয়নি। শ্রমিকরা সেই শুরু থেকে এখন পর্যন্ত লাগাতার এবং দ্বিধাহীনভাবে লড়াই করে যাচ্ছে। শ্রমিকরা আন্দোলন করে হাজার হাজার ছাটাই পুনর্বহাল করেছে, অনেক কারখানায় পূর্ণ বোনাস আদায় করেছে, মালিকদের লে-অফ চক্রান্ত প্রতিরোধ করেছে। এমন মহাদুর্যোগকালে বাঁচতে চাইলে গার্মেন্ট শ্রমিকদের কাছ থেকে অন্যদের কিছু শেখার আছে। কিভাবে নিজের অধিকার আদায়ে সোচ্চার হতে হয় এবং কিভাবে সংগঠিত থাকতে হয় এটা এই মূহুর্তে আমাদের আয়ত্ত করতেই হবে। একে অন্যের পাশে, নিজেরা নিজেদের পাশে না দাড়ালে আমরা কেউ বাঁচবো না।

জলি তালুকদার; সম্পাদক, সিপিবি কেন্দ্রীয় কমিটি এবং সাধারণ সম্পাদক, গার্মেন্ট শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র।

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *