প্রধানমন্ত্রীর জন্য উপহার যেভাবে কিনেছিলেন চা-শ্রমিকরা

চা-শ্রমিকদের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভিডিও কনফারেন্সে আলোচনার বিষয় ছাড়িয়ে এক দশক আগের সোনার বালা উপহার পাওয়া নিয়ে তুমুল আলোচনা।

বঙ্গবন্ধুকন্যা শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলার সময় দুই হাত উঁচু করে বালা দুটি দেখিয়ে বলেছেন, এটি তার জীবনের সবচেয়ে বড় উপহার।

তিনি বলেন, ‘আপনারা গণভবনে আমার সঙ্গে সাক্ষাতের সময় আমার জন্য সোনার চুড়ি উপহার নিয়ে এসেছিলেন। সেই উপহার এখনও আমি হাতে পরে বসে আছি।

‘আমি কিন্তু ভুলিনি। আমার কাছে এটা হচ্ছে সব থেকে অমূল্য সম্পদ। চা শ্রমিক ভাইবোনেরা চার আনা, আট আনা করে জমিয়ে আমাকে এই উপহার দিয়েছেন। এত বড় সম্মান, এত বড় উপহার আমি আর কখনও পাইনি।’

শেখ হাসিনা সেদিনই জানান, ২০১২ সালে হবিগঞ্জের চা শ্রমিকরা বালা দুটি উপহার দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রীকে।

সেদিন প্রধানমন্ত্রী আবেগতাড়িত হয়ে কেঁদে ফেলে শ্রমিকদের জড়িয়ে ধরেন বলে জানান শ্রমিকরা।

এবার শ্রমিকদের আন্দোলনের সময়ই প্রকাশ পেয়েছে শেখ হাসিনাকে সবাই ‘মা’ বলে ডাকেন।

ওই বছরের ৩ জুলাই গণবভনে শেখ হাসিনার কাছে নিজেদের বঞ্চনার কথা জানাতে যান হবিগঞ্জের ১৬ চা শ্রমিক। এর মধ্যে চারজন ছিলেন নারী। নেতৃত্বে ছিলেন বাংলাদেশ আদিবাসী সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি কাঞ্চন পাত্র।

তিনি বলেন, ‘তখন শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি ছিল ২৪ থেকে ২৮ টাকা। অনাহারে অর্ধাহারে দিন কাটত অধিকাংশ চা শ্রমিকদের। চরমভাবে শিক্ষা, চিকিৎসা, বাসস্থানসহ মৌলিক অধিকার বঞ্চিত ছিল চা শ্রমিকরা। তাই বাধ্য হয়ে নিজের দুঃখ-দুর্দশার কথা জানাতে গণভবনে যাই আমরা ১৬ জন। কিন্তু তখন আমাদের মায়ের জন্য কী উপহার নেব বুঝে পাচ্ছিলাম না। হঠাৎ সিদ্ধান্ত হলো যে করেই হোক ওনার জন্য এক জোড়া স্বর্ণের বালা নেব।’

কাঞ্চন বলেন, ‘তখন শ্রমিকদের হাতে টাকা নেই। আমরা বালার জন্য চাঁদা তুলতে শুরু করি। কেউ আট আনা, কেউ এক টাকা, কেউ ১০ টাকা আবার কেউ এক শ, দুই শ টাকা দিয়েছিল। সব মিলিয়ে হবিগঞ্জের বাগানগুলো থেকে আমরা আড়াই লাখ টাকা তুলেছিলাম। সেই আড়াই লাখ টাকা দিয়ে ৫ ভরি ওজনের একজোড়া বালা কিনি। তখন স্বর্ণের দাম ছিল প্রতি ভরি ৪৯ হাজার টাকার কিছু বেশি।’

প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তখন দেখা করতে যাওয়া ১৬ জনের মধ্যে ছিলেন চাঁন্দপুর চা বাগানের নারী শ্রমিক গীতা পাত্র। তিনি বলেন, ‘বালা দুটি আমাদের মা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে আমরা নিজেরাই পরিয়ে দিয়েছিলাম। যখন তিনি শুনেছেন আমরা আট আনা-চার আনা-এক টাকা করে চাঁদা তুলে বালাগুলো কিনেছি, তখন তিনি কেঁদে দিয়েছিলেন এবং আমাদের বুকে টেনে নিয়েছিলেন।’

তিনি বলেন, ‘আমাদের মা তখন আমাদের দুঃখ-দুর্দশার কথা শুনে দৈনিক মজুরি ২৮ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৬৯ টাকা করে দিয়েছিলেন। তখনও তিনি আমাদের মুখে হাসি ফুটিয়েছিলেন, এখন আবারও তিনি মজুরি ৫০ টাকা বাড়িয়ে আমাদের মুখে হাসি ফুটিয়েছেন।’

দৈনিক মজুরি ৩০০ টাকার দাবিতে গত ৯ আগস্ট থেকে আন্দোলন করছিলেন চা শ্রমিকরা। টানা ১৮ দিন কর্মবিরতির পর প্রধানমন্ত্রী তাদের মজুরি ৫০ টাকা বাড়িয়ে ১৭০ টাকা করেছেন। শ্রমিকরা কাজে ফিরলেও দাবি জানিয়ে আসছিলেন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সরাসরি কথা বলার জন্য। সে সুযোগ হয়েছে শনিবার বিকেলে।

দেশের কোনো প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে এভাবে কথা বলার সুযোগ পেয়ে শ্রমিকরা আবেগে ছিলেন দিশেহারা। তা শতগুণ বাড়িয়ে দেয় প্রধানমন্ত্রীর আন্তরিকতাপূর্ণ নানা বক্তব্য ও স্মৃতিচারণা।

চা শ্রমিকরা নিজেদের দাবি জানানোর পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রীর প্রতি নিজেদের অনুরাগ ও আস্থার কথা জানান।

শ্রমিকদের সব কথা মনোযোগ সহকারে শুনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমাদের চা শ্রমিকরা, যাদের ব্রিটিশরা একসময় নিয়ে এসেছিল, তাদের অমানবিক অত্যাচার করত, খাটাত। জাতির পিতা শেখ মুজিব টি বোর্ডের চেয়ারম্যান হওয়ার পরে বিভিন্ন ব্যবস্থা নেন এবং পরবর্তীতে তাদের নাগরিকত্ব দেন, ভোটের অধিকার দেন।

‘ভোটের অধিকার পেয়েছে, নাগরিকত্ব পেয়েছে, কিন্তু তারা ভূমিহীন থাকবে, এটা তো হতে পারে না। সকলের জন্য বাসস্থানের ব্যবস্থা ইনশাআল্লাহ আমি করেছি। এ ছাড়া আপনাদের শিক্ষা, চিকিৎসার সুব্যবস্থা ও মাতৃত্বকালীন ছুটি ৬ মাস করে দেব।’

 

শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *